বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে পর্যটন স্থান, ট্যুরের কথা আসলেই কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সাজেক ইত্যাদি নামগুলোই ঘুরে ফিরে আসে। যা মূলত দক্ষিন ও দক্ষিন-পূর্বাংশে অবস্থিত।
তবে বেশি কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান থাকা সত্বেও দেশের উত্তর বঙ্গ তথা উত্তরের অঞ্চল সমূহ যেমন নাটোর, রাজশাহী, চাপাই নবাবগঞ্জ, পঞ্চগড়, রংপুর ইত্যাদি অঞ্চল গুলো বেশ অবহেলিত। এসব অঞ্চল বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পর্যটন স্পট রয়েছে। তবে স্থানীয় ও আশে পাশের জেলা ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে এসব স্পটে সেরকম দর্শনাথী আসেনা বললেই চলে। আজকের পোস্ট টি উত্তর বঙ্গের বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান নিয়ে সাজানো হয়েছে
ছোট সোনা মসজিদ -চাঁপাইনবাবগঞ্জ:
বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ হল চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত এই ছোট সোনা মসজিদ। প্রায় ৫০০ বছরের ইতিহাস হয়ে দাড়িয়ে রয়েছে এই মসজিদটি। এই মসজিদ টি বাংলার স্বাধীন সুলতানি শাসনামলের স্থাপত্য শৈলীর এক অনন্য নিদর্শন।
একসময় মসজিদের বাইরের অংশটি ছিল সোনালী রংয়ে সজ্জিত। সূর্যের আলোতে দৃস্টি নন্দন এক রূপ ধারন করত এই মসজিদটি। সেই থেকেই এই মসজিদের নাম হয় সোনা মসজিদ।তবে শত বছরের নানা পরিবর্তন, ঝড় বৃস্টির প্রভাব আর উপযুক্ত যত্ন - সংস্কারের অভাবে এর সোনালী রংয়ের ছাপের কিছুই অবশিষ্ট নেই এখন। পূর্বের রূপ - জৌলুস হারিয়ে এটি শুধু প্রাচীন ঐহিত্যের সাক্ষী হিসেবে দাড়িয়ে রয়েছে। বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ এর শাসনামলে ( ১৪৯৩-১৫১৯) এই নির্মিত হয়।মসজিদের মূল কাঠামোটি ইটের তৈরী এবং তার উপরের পাথরের স্তর রয়েছে। মসজিদের দুই পাশে ছয়টি করে মোট বার টি গম্বুজ ও মধ্যাংশে পাশাপাশি তিনটি বড় গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজের ভিতরের অংশে রয়েছে দৃস্টিনন্দন কারুকার্য। প্রায় পাচ শত বছর পূর্বে নির্মিত এই মসজিদের বর্তমানেও যা অবশিষ্ট আছে তা দেখলে বিষ্মিত হতে হয়।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার - নওগাঁ:
বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐহিত্যের আরেক নিদর্শন হল পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার।এটি সোমপুর বিহার নামেও পরিচিত। এটি নওগাঁয় অবস্থিত। এটি দক্ষিন এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন ও বড় বৌদ্ধ বিহার গুলির একটি। ইউনেস্কো কতৃক " ওয়াল্ড হেরিটেজ " এর তালিকা ভুক্ত একটি স্থাপনা।। এটি প্রায় তিন শত বছর ধরে বৌদ্ধদের বিখ্যাত ধর্ম চর্চা কেন্দ্র ছিল। আয়তনে এটি ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য। পৃথিবীতে এপর্যন্ত প্রাচীন জ্যামিতিক নকশার যত স্থাপনা আবিষ্কৃত হয়েছে তারমধ্যে এই নওগাঁর বৌদ্ধ বিহার অন্যতম। কেউ কেউ ধারনা করেন এটি প্রথমে জৈন মন্দির ছিল এবং পরবর্তিতে মন্দিরের উপরেই বিহারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে প্রায় ১৭০ টি ঘর ছিল যেগুলোতে বৌদ্ধ ভিক্ষু রা বসবাস করত। বিহারটির মাঝে প্রায় ৪০০ ফুট লম্বা ও ৩৫০ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি মন্দির রয়েছে। ধারনা করা হয় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ৮ম থেকে ৯ম শতকে।
পাল রাজ বংশের রাজা দ্বিতীয় ধর্মপাল এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্ম চর্চার পাশাপাশি এটি ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে চীন, তিব্বত এমন কি ইন্দোনেশিয়ান অঞ্চল গুলো থেকে শিক্ষার্থী রা আসতো । ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক বার্নিংহাম এটি প্রথম আবিষ্কার করেন।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন এই পাহাড় পুর বৌদ্ধ বিহার।
উত্তরা গনভবন - নাটোর :
নাটোরের দীঘাপতিয়া রাজবাড়ি যা বর্তমানে উত্তরা গন ভবন নামে পরিচিত একটি দৃস্টি নন্দন ঐতিহাসিক স্থান। এটি এক সময় নাটোরের রানী ভবানির সম্পত্তি ছিল। তিনি পরবর্তি তে এটি তার নায়েব দয়ারাম কে এটি উপহার দেন। এটি প্রাচীন বাংলার এক বিস্ময়কর স্থাপনা। প্রায় ৪৩ একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই রাজাবাড়ি টি। রয়েছে মোট ১১ টি ভবন। প্রাসাদের মূল ভবনে সজ্জিত রয়েছে রাজ সিংহাসন, বর্ম, তালোয়ার ইত্যাদি। রয়েছে মনোমুগ্ধকর একটি বাগান যেখানে শোভা পায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সমারোহ। এখানে অন্যতম দুটি বৈদেশিক আকর্ষন হল পিরামিড আকৃতির প্রবেশদ্বারের উপরে স্থাপিত ব্রিটিশ " কোক এন্ড টেলভি" র তৈরী বিশালাকার শত বর্ষী ঘড়ি ও ইতালি থেকে আনা ভাষ্কর্য যা বাগানে প্রদর্শিত রয়েছে। এটি এমন এক স্থান যেখানে প্রাচীন বাংলার স্থাপত্য শৈলি, ব্রিটিশ শাসনামলের ছোয়া, সূদুর ইতালির ভাস্কর্যের নমুনা সব মিলিয়ে কয়েক শতাব্দী ও পৃথীবির ভিন্ন তিনটি অঞ্চলের আবেশ একত্রিত করেছে।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে ১৯৭২ সালে এটি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে ঘোষনা করা হয়। সেই সাথে এর নাম দেয়া হয় "উত্তরা গনভবন"।
ইতিহাস - ঐতিহ্য আর স্থাপনায় সমৃদ্ধ দেশের উত্তর বঙ্গ আমাদের গর্ব। দেশের এই ঐতিহাসিক স্থাপনা গুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ ও হাজার বছরের ইতিহাসের অংশ।