জেনে নেই ওমরাহ্ সম্পর্কে
ওমরাহ হজের মতোই একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা বছরের যে কোনো সময় পালন করা যায়। এটি মূলত ইহরাম পরিধান, কাবা শরিফ তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ এবং মাথা মুন্ডন বা চুল ছোট করার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ইহরাম অবস্থায় কিছু নির্দিষ্ট কাজ নিষিদ্ধ থাকে, যেমন—সেলাইযুক্ত পোশাক পরা, সুগন্ধি ব্যবহার, চুল-নখ কাটা ইত্যাদি। উমরাহ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং আত্মশুদ্ধির সুযোগ পাওয়া যায়। সঠিক নিয়ম মেনে পালন করলে উমরাহ পূর্ণতা লাভ করে।

ওমরাহ পালনের নিয়ম ও শরিয়তসম্মত পদ্ধতি নিয়ে আমাদের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। অনেক সময় সঠিক মাসলা-মাসায়েল সম্পর্কে অস্পষ্টতা দেখা দেয়। তাই, আমরা কোরআন ও হাদিসের আলোকে ওমরাহ পালনের নিয়মগুলি সহজ ও স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করব।
ওমরাহ হজ্জ সদৃশ একটি মহান সুন্নাত এবাদত। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন, “আর তোমরা হজ ও ওমরাহ পূর্ণ কর আল্লাহর উদ্দেশ্যে...” (সূরা বাকারা: আয়াত ১৯৬)।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তিনবার হজ করেছেন—দুইবার হিজরতের আগে এবং একবার হিজরতের পর। এই শেষোক্ত হজের সঙ্গে তিনি ওমরাহও আদায় করেছিলেন (তিরমিজি, হাদিস: ৮১৫)।
হজরত কাতাদা (রহ.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আনাস (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, আল্লাহর রাসুল (সা.) কতবার ওমরাহ আদায় করেছেন? তিনি বললেন, চারবার। এর মধ্যে রয়েছে হুদায়বিয়ার ওমরাহ, যখন মুশরিকরা তাঁকে মক্কায় প্রবেশে বাধা দেয়; পরবর্তী বছরের জুলকাদা মাসের ওমরাহ, যখন মুশরিকদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়; জিরানার ওমরাহ, যেখানে নবী (সা.) গনিমতের মাল বণ্টন করেন, সম্ভবত হুনায়নের যুদ্ধের পর; এবং চতুর্থ ওমরাহ। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, নবী (সা.) কতবার হজ করেছেন? তিনি বললেন, একবার (বুখারি, হাদিস: ১৭৭৮)।
ওমরাহ শব্দের অর্থ হলো জিয়ারত, সাক্ষাৎ বা পরিদর্শন। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় বাইতুল্লাহ শরিফ জিয়ারত এবং সাঈ করাই মূলত ওমরাহ। হজ ও ওমরাহর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। সহজভাবে বলা যায়, হজ পালিত হয় নির্দিষ্ট সময়ে—৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত, আর ওমরাহ বছরের যেকোনো সময় পালন করা যায়। ইহরাম পরিধান করে কাবা শরিফ তাওয়াফ করা এবং সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাঈ করাই ওমরাহর মূল বিধান। ওমরাহ পালনকারীকে মুতামির বলা হয়।
আল্লাহ আমাদের ওমরাহর পবিত্র ইবাদত সুন্দর ও সঠিকভাবে পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
ইহরাম:
আভিধানিক অর্থ ও প্রস্তুতি
ইহরাম শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো নিষিদ্ধ বা হারাম। ইসলামী পরিভাষায়, ইহরাম হলো নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করে, নিয়ত ও তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে কিছু হালাল কাজ সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ মেনে নিয়ে হজ বা উমরাহ পালনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। পুরুষরা ইহরামের জন্য সেলাইবিহীন দুটি সাদা চাদর পরিধান করবেন, আর নারীরা তাদের সাধারণ পোশাক পরেই ইহরামে প্রবেশ করবেন।
ইহরাম বাঁধার পূর্বে করণীয় কাজসমূহ
১. শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা—হাত ও পায়ের নখ কাটা, গোফ ছাঁটা, চুল ও নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা ইত্যাদি।
2. ইহরামের আগে গোসল করা সুন্নত।
3. পুরুষরা সেলাইবিহীন ইহরামের পোশাক এবং নারীরা শালীন ও উপযুক্ত পোশাক পরিধান করবেন।
4. গোসলের পর ওযু করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করা।
5. মীকাত বা তার পূর্বে উমরাহ বা হজের নিয়ত করা।
6. তালবিয়া পাঠ করা:
তালবিয়া:
لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْك، لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْك، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لَا شَرِيكَ لَكَ
অর্থ:
"আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিতে এসেছি। আপনার কোনো অংশীদার নেই। নিঃসন্দেহে সমস্ত প্রশংসা, নেয়ামত এবং সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আপনারই। আপনার কোনো অংশীদার নেই।"
পুরুষদের তালবিয়া উচ্চস্বরে পাঠ করতে হবে, আর নারীরা নিচু স্বরে পড়বেন।
ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজসমূহ
ইহরাম বাঁধার পর কিছু কাজ নিষিদ্ধ হয়ে যায়, এমনকি কিছু হালাল কাজও তখন নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এগুলো হলো:
১) সেলাইযুক্ত কোনো কাপড় বা জুতা ব্যবহার করা (স্পঞ্জ সেন্ডেল পরিধান করা যাবে)।
২) মাথা ও মুখমণ্ডল (ইহরামের কাপড় বা অন্য যে কোনো কাপড় দ্বারা) ঢাকা।
৩) পায়ের পিঠ ঢেকে যায় এমন জুতা পরা।
৪) চুল কাটা বা ছেঁড়া। ৫) নখ কাটা।
৬) সুগন্ধি বা আতর ব্যবহার করা।
৭) স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা।
৮) অশালীন কোনো আচরণ বা কথা বলা।
৯) শিকার করা।
১০) ঝগড়া-বিবাদ বা মারামারি করা।
১১) চুল-দাড়িতে চিরুনি বা আঙুল চালানো, যাতে ছেঁড়ার আশঙ্কা থাকে।
১২) শরীরে সাবান ব্যবহার করা।
১৩) উকুন, ছারপোকা, মশা ও মাছিসহ কোনো জীব হত্যা করা।
৪) যে কোনো ধরনের গুনাহের কাজ করা।
পবিত্র কাবা ঘর তাওয়াফ
তাওয়াফ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পরিদর্শন বা প্রদক্ষিণ। ইসলামী পরিভাষায়, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, নির্দিষ্ট পোশাক পরিধান করে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পবিত্র কাবা শরীফের চারদিকে প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলা হয়।
তাওয়াফের পূর্বে পালনীয় নিয়মাবলী
১. তাওয়াফের জন্য নিয়ত করা।
২. পবিত্র কাবাকে কেন্দ্র করে সাতবার নিরবিচারে প্রদক্ষিণ করা।
৩. তাওয়াফের জন্য ওজু বা গোসল করে পবিত্র হওয়া।
৪. শরীরের সতর ঢেকে রাখা।
৫. সক্ষম ব্যক্তি হেঁটে তাওয়াফ করা।
৬. কাবা শরীফকে বাম পাশে রেখে তাওয়াফ করা।
৭. হাতিমের বাহির দিয়ে তাওয়াফ সম্পন্ন করা।
৮. তাওয়াফ শেষ হলে দুই রাকাত সালাত আদায় করা।
৯. হজরে আসওয়াদ থেকে তাওয়াফের প্রতিটি চক্কর শুরু করা।
১০. হজরে আসওয়াদে চুম্বন করা, স্পর্শ করা বা সম্ভব হলে হাত উঁচিয়ে ইশারা করা।
১১. ওমরাহ পালনকারীর তাওয়াফে ইজতিবা ও রমল করা।
১২. প্রতি চক্করে রুকুনে ইয়ামানী স্পর্শ করা, সম্ভব না হলে ইশারা করা এবং দোয়া পাঠ করা।
উমরাহর ওয়াজিবসমূহ
ওমরাহ পালনের জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব রয়েছে—সায়ী করা এবং মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা।
প্রথম ওয়াজিব- সাঈ করা
সায়ী বলতে বোঝায় পবিত্র সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে নির্দিষ্ট নিয়মে যাওয়া-আসা করা। হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর স্ত্রী হযরত হাজরা (রাঃ) শিশু পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)-এর জন্য পানি খুঁজতে গিয়ে সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাতবার দৌঁড়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা তার এই ত্যাগ ও চেষ্টা এতটাই পছন্দ করেছেন যে, এটি হজ ও উমরাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নির্ধারিত করেছেন।
সাঈ করার নিয়ম
সাফা পাহাড়ে গিয়ে নিয়ত করা এবং কুরআনের এই আয়াত পাঠ করা:
"إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللَّهِ"
(নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া মহান আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম…) (সূরা বাকারা: ১৫৮)।
সাফা পাহাড়ের ওপরে উঠে কাবার দিকে মুখ করে আল্লাহর তাসবীহ ও দোয়া পাঠ করা:
> "লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ইউহয়ী ওয়া ইউমীত, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর"।
> "লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু, আনজাযা ওয়াদাহু, ওয়া নাসারা আবদাহু, ওয়া হাজামাল আহযাবা ওয়াহদাহু"।
>সাফা থেকে মারওয়ার দিকে যাত্রা করা।
> পথিমধ্যে দুই সবুজ বাতির মাঝে পৌঁছালে পুরুষদের দ্রুতগতিতে চলতে হবে ।
>দ্রুত চলার সময় এই দোয়া পড়তে হবে: "রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আনতাল আ’আজ্জুল আকরাম"।
মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছে সাফায় যেভাবে দোয়া পড়া হয়েছে, সেভাবেই তাসবীহ ও দোয়া পড়তে হবে।
>মারওয়া থেকে আবার সাফায় ফিরে আসতে হবে, এবং সবুজ বাতির মাঝে আবার দ্রুতগতিতে চলতে হবে।
>এইভাবে সাতবার সম্পন্ন করতে হবে, যার শেষটি মারওয়া পাহাড়ে গিয়ে শেষ হবে।
সাঈ করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই, তবে আল্লাহর কাছে ইচ্ছেমতো দোয়া করা যেতে পারে। এটি দোয়া কবুলের অন্যতম স্থান বলে গণ্য হয়।
দ্বিতীয় ওয়াজিব- মাথা মুন্ডন (হালক) বা চুল ছোট করা (কাসর)
ওমরাহ শেষ ধাপে এই ওয়াজিবটি পালন করতে হবে। সায়ী শেষ করার পর
>পুরুষরা তাদের সম্পূর্ণ মাথার চুল কামিয়ে ফেলবে (হালক) অথবা ছোট করে ছেঁটে ফেলবে (কাসর)
>নারীরা চুলের অগ্রভাগ থেকে প্রায় আধা আঙুল পরিমাণ কেটে ফেলবে।
এই আলোচনা থেকে আমরা ওমরাহ পালনের নিয়মগুলো বিশদভাবে জানতে পারলাম। ওমরাহ পালনের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পাই এবং আত্মশুদ্ধির পথে অগ্রসর হতে পারি। ওমরাহ পালন আমাদের জন্য একটি বিশাল নিয়ামত, যা যথাযথভাবে পালন করা দরকার। এজন্য আমাদের সঠিক মাসয়ালা-মাসায়েল জানা এবং সে অনুযায়ী আমল করাই একান্ত প্রয়োজন। আশাকরি, এই নির্দেশনাগুলি ওমরাহ পালনের ক্ষেত্রে আপনাদের জন্য সহায়ক হবে, ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে ওমরাহর সঠিক নিয়ম জানার এবং তা অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
What's Your Reaction?






