বগুড়ায় অবস্থিত মহাস্থানগড় বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হওয়া প্রাচীন তম স্থাপনা। এটি বগুড়ার শিবগঞ্জ এর করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। প্রাচীন কালে এটি ছিল পূন্ড্রবর্ধনের অংশ। প্রাচীন বাংলায় পূন্ড্রবর্ধন ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। বর্তমানের মহাস্থনগড় ছিল প্রাচীন পূন্ড্রবর্ধনের রাজধানী পূন্ড্রনগর।এটি ছিল একই সাথে প্রাচীন মৌর্য,গুপ্ত, পাল ও সেন এবং পরবর্তি তে মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলে র অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অঞ্চল। ২০১৬ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধীদপ্তর থেকে এই মহাস্থানগড় কে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী র মর্যাদা দেয়া হয়।
প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক "হিউয়েন সাঙ" তার ভ্রমনলিপি তে মহাস্থান গড় কে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। এটি ছিল প্রায় ৫ কি:মি বিস্তৃত একটি দূর্গ বেষ্ঠিত শহর। ১৫ থেকে ২০ ফুট উচু মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বর্তমানে এখানে ধ্বংসাবশেষ হিসেবে রয়েছে - ইমারত, শিলালিপি,ধর্মীয় স্থাপনা। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এখানে ব্যপক খনন কার্য চালিয়ে অনেক মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার করেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল
মৌর্য ও গুপ্ত শাসনামলের মুদ্রা, শিলালিপি ও পোড়ামাটির ফলক, বিভিন্ন মূর্তি, মসজিদ, মন্দিরে র ধ্বংসাবশেষ। এই স্থানটি একই সাথে মুসলিম, হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছে গুরুত্বপূর্ন। এখানে রয়েছে সুলতান বলখীর মাজার, গোপাল মন্দির ও বৌদ্ধ বিহার। এখানে থেকেই বুঝা যায় সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও ঐতিহ্য গতভাবে স্থাপনা টি কতটা গুরুত্বপূর্ন। পৃথিবীর খুব কম প্রাচীন স্থাপনাই একই সাথে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় নিদর্শনে সমৃদ্ধ রয়েছে। এই মহাস্থান গড় প্রাচীন ও মধ্য যুগ এবং মুসলিম যুগ, তিন সময়ের শতাব্দীর পর শতাব্দীর ইতিহাস একত্রিত করেছে। অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইতিহাসের এই স্থাপনাটা যথেষ্ট প্রচার প্রচারনা র অভাবে যথেস্ট দর্শক আকৃস্ট করতে পারছে না। অথচ উপযুক্ত রক্ষনা বেক্ষন, সংস্কার ও প্রচার প্রচারনা করলে এটি দেশে - বিদেশের প্রসিদ্ধ একটি পর্যটন স্পট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।
কান্তজির মন্দির -দিনাজপুর
কান্তজির মন্দির বাংলাদেশেন প্রাচীন স্থাপত্যশৈলির এক নিদর্শন। ঢেঁপা নদীর তীরে অবস্থিত এই মন্দির টি নবরত্ন মন্দির নামেও পরিচিত। ১৮ শতকে নির্মিত এই মন্দিরটি আজও সমৃদ্ধ ইতিহাসের সাক্ষি হিসেবে দাগিয়ে রয়েছে। মন্দির থেকে সংগৃহীত শিলালিপি থেকে জানা যায় যেসময়ের রাজা প্রাণনাথ রায় এই মন্দির টি নির্মান শুরু করেন। রাজার মৃত্যুর পরে পরবর্তিতে রাজা রাজারাথ রায় এটি নির্মান সম্পূর্ন করেন। প্রায় ৫০ বছর সময় নিয়ে নির্মিত সেসময় কতটা জৌলসপূর্ন ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ৯টি চূড়াই ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে মন্দিরটি সংস্কার করা হলেও চূড়াগুলো আর নির্মান করা হয়নি। তাই নির্মান কালে মন্দির টি প্রায় ৭০ ফুট উচ্চতা থাকলেও বর্তমানে এটি ৫০ ফুট মত উচু। মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে রয়েছে " টেরাকোটা টালি" বা পোড়ামাটির ফলক। প্রায় ১৫,০০০ টেরাকোটা টালি জুড়ে রয়েছে রামায়ন, মহাভারত ও বিভিন্ন পৌরানিক কাহিনির বর্ননা। দিনাজপুরের এই প্রাচীন স্থাপনা টি আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাসের এক উজ্জল নিদর্শন। এদেশের শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্যের সাক্ষী এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলো।
তাজহাট জমিদার বাড়ি
এটি রংপুরের এক ঐতিহাসিক পর্যটন স্পট। তাজহাট এলাকার জমিদার গোপাল রায় ১৯০৬-১৯০৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় প্রায় ২০০০ শ্রমিকের নিরলস পরিশ্রমে এই বাড়িটি নির্মিত হয়। তৎকালীন সময়ের প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ হয় এই জমিদার বাড়িটি নির্মান করতে। এ থেকে বোঝা যায় কতটা যত্ন, জৌলুশ ও আভিজাত্যের ছাপ রেখে প্রাসাদ টি নির্মিত হয়েছিল। বিশাল মাঠ, সাথে সারি সারি নানা প্রজাতীর গাছ, আম বাগান, বিভিন্ন প্রজাতীর ফুল গাছে বাড়ির চারপাশ সাজানো।এই জমিদার বাড়িটির সাথে ঢাকার নবাব আমলের আরেক স্থাপত্য আহসান মঞ্জিল এর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। বিশাল এই প্রাসাদের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় প্রদর্শিত রয়েছেজমিদার দের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস। প্রাসাদটিতে একই সাথে মূঘল স্থাপত্যের ছোয়া এবং ইতালির রেনেসাঁ র স্থাপত্য ধাচের ও মিল পাওয়া যায়। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯৫ সালে তাজহাট জমিদার বাড়িকে "সরকারি সংরক্ষিত স্থাপনা" হিসেবে ঘোষনা করে। এখানের জাদুঘরে প্রায় ৩০০ টির মত প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। এর মধ্যে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলের কোরআন শরীফ, আরবী - সংস্কৃত ভাষায় লেখা বেশ কিছু পান্ডু লিপি, বিভিন্ন ধরনের মূর্তি অন্যতম। সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য সংস্কৃতির এক মিলন মেলা এই তাজহাট জমিদার বাড়িটি।
উত্তরবঙ্গের এই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো আমাদের দেশের গর্ব ও অতীত ঐতিহ্যের স্বাক্ষর। যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রচারের মাধ্যমে এগুলোকে আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। ইতিহাসপ্রেমী ও পর্যটকদের জন্য এই স্থানগুলো এক অনন্য অভিজ্ঞতা প্রদান করতে পারে।