রোমাঞ্চকর সৌন্দর্যের সুন্দরবন

সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন এবং ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য। প্রায় ৬,০০০ বর্গকিঃমিঃ জুড়ে অবস্থিত এ বন খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও বরগুনা জুড়ে রয়েছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, কুমিরসহ নানা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল এটি। নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও অ্যাডভেঞ্চারের এক অপূর্ব সমন্বয় সুন্দরবন, যা প্রকৃতি ও রোমাঞ্চপ্রেমীদের জন্য চিরস্মরণীয় ভ্রমণের স্থান।

রোমাঞ্চকর সৌন্দর্যের সুন্দরবন

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট খ্যাত সুন্দরবন প্রকৃতির এক অপরূপ সৃষ্টি  বাংলাদেশের রোমাঞ্চকর পর্যটন স্পটের নাম বললে প্রথমেই সুন্দরবনের নাম আসবে। সুন্দরবনের মোট আয়তন প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার যার মধ্যে বাংলাদেশের অংশেই রয়েছে ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার। বিশাল এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট দেশের দক্ষিন অঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা জুড়ে বিস্তৃত। খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি,সাতক্ষিরা, পটুয়াখালি, বরগুনা দক্ষিন প্রান্তের অংশগুলো জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন।  সুন্দরবনের প্রায় ১৮০০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ নদী, নালা,বিল - জলাভূমি। বিশ্ব বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিন, শত রকমের পাখি, সাপ, কুমির সব মিলিয়ে সুন্দরবনকে প্রকৃতি উজাড় করে ঢেলে সাজিয়েছে। এটি ইউনেস্কোর ওয়াল্ড হেরিটেজের তালিকাভুক্ত। ভ্রমন প্রেমীদের মধ্যে যারা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সাথে এডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাদের জন্যে সুন্দরবন মাস্ট ভিজিট একটি স্পট।  এখানে অপরূপ সুন্দর চিত্রল হরিনের দেখা যেমন মিলবে, সাথে ভয়ঙ্কর সুন্দর রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডেরাকাটা দাগ আর মাটি কাপান হুঙ্কার -যে কারো স্পাইন চিল অনুভূতি জাগাবে।

 

 ভ্রমনের উপযুক্ত সময়

সাধারনত শীত কাল -নভেম্বর থেকে ফেব্রুআরি বা মার্চ পর্যন্তও সুন্দর বনে যাওয়া যায়। এই সময় সাধারনত ঝড় - বন্যা এরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকেনা। সাগর বেশ শান্ত থাকে। তাই নদী-সাগর বেষ্ঠিত সুন্দরবন এই সময়ে যাওয়াই উপযুক্ত।

দর্শনীয় স্থান সমূহ

সুন্দরবন অনেক বিশাল অঞ্চল নিয়ে গঠিত। কেউ চাইলেই সুন্দরবনে ইচ্ছামত ঘুরতে পারবে না। বনবিভাগ - স্থানীয় প্রসাশন থেকে নিরাপদ ভাবে কিছু দর্শনীয় স্থান করা হয়েছে। সেই স্থান গুলোই ঘুরে দেখা যায়। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হল

কটকা

কটকা সুন্দরবনের অন্যতম বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র, যেখানে বাঘ, হরিণ এবং নানা বন্যপ্রাণী দেখার সম্ভাবনা থাকে। সুন্দরবনের গভীরে অবস্থিত কটকা সমুদ্র সৈকতটি মনোমুগ্ধকর এবং পরিবেশ অত্যন্ত নির্জন আকর্ষণীয়। কটকা ওয়াচ টাওয়ার থেকে চারপাশের বন, বন্যপ্রাণী এবং মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করা যায়। এছাড়া এখানে বাঘের চলাচলের বিশেষ চিহ্ন রয়েছে, যা পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয়।

কচিখালী

কচিখালী কটকার নিকটবর্তী একটি দর্শনীয় স্থান, যা বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণের জন্য আদর্শ। এটি একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যেখানে হরিণ, বন্য শুকর এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায়। কচিখালীর সমুদ্র সৈকত শান্ত নির্জন, যেখানে সূর্যাস্তের দৃশ্য অত্যন্ত চমৎকার।

 হিরণ পয়েন্ট (নিলকমল)

হিরণ পয়েন্ট সুন্দরবনের অন্যতম সুন্দর জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র, যা রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার জন্য উপযোগী। এখানে উঁচু ওয়াচ টাওয়ার থেকে বনের অপূর্ব শোভা উপভোগ করা যায়। বনের মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, বানর নানা প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এছাড়া এখানকার ঘন ম্যানগ্রোভ বন দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।

দুবলাচর (দুবলার চর)

দুবলার চর সুন্দরবনের একটি ব্যতিক্রমী স্থান, যেখানে প্রতিবছর রাস পূর্ণিমার মেলা হয়। এটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি বিশেষ ধর্মীয় পর্যটন কেন্দ্র। মাছ ধরার মৌসুমে এখানে জেলেরা অস্থায়ী বসতি স্থাপন করে এবং মাছ শুকানোর কাজ করে। চরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নির্জন পরিবেশ পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

করমজল

করমজল সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত এবং সবচেয়ে সহজে ঘোরা যায়। এটি একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যেখানে পর্যটকরা নৌকাভ্রমণের মাধ্যমে বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। এখানে রয়েছে কুমির প্রজনন কেন্দ্র, যা পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। এছাড়া বানর, চিত্রা হরিণ, নানা প্রজাতির পাখি এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণীও এখানে দেখা যায়। করমজলে কাঠের পথচলা (ওয়াকওয়ে) রয়েছে, যা দিয়ে সহজেই বনের ভেতরে প্রবেশ করা যায়।

মণ্ডারবাড়িয়া সৈকত

মণ্ডারবাড়িয়া সৈকত তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত কিন্তু অত্যন্ত সুন্দর শান্তিপূর্ণ একটি স্থান। এখানে সমুদ্রের ঢেউ আর বনের নিস্তব্ধতা একসঙ্গে উপভোগ করা যায়। নির্জনতা প্রকৃতির অপূর্ব সমন্বয়ের কারণে এটি প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য আদর্শ স্থান। পর্যটকদের সংখ্যা কম থাকায় এখানে বেশ নিরিবিলি সময় কাটানো যায়।

শরণখোলা রেঞ্জ

শরণখোলা সুন্দরবনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত এবং এটি পর্যটকদের জন্য জনপ্রিয় একটি স্থান। এটি সুন্দরবনের অন্যতম প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে বনভ্রমণ, নৌকা ভ্রমণ এবং বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ করা যায়। অঞ্চলে নানা প্রজাতির পাখি জলজ প্রাণীও রয়েছে।

 সুন্দরবন ভ্রমণের উপায়

সুন্দরবন ভ্রমণের জন্য আপনাকে ট্যুর প্লান সাজাতে হবে। আপনার জন্য সুবিধা জনক হবে সেরকম মাধ্যমে যেতে হবে।  সাধারণত ঢাকা, খুলনা বা মোংলা থেকে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে নৌপথে যাওয়া হয়। ভ্রমণের প্রধান উপায়গুলো তুলে ধরা হল।

নৌপথে ভ্রমণ

সুন্দরবনের মূল আকর্ষণ নৌযানে ঘুরে দেখা। খুলনা, মোংলা বা শরণখোলা থেকে নৌকা বা লঞ্চ ভাড়া করে সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে যাওয়া যায়।

  • খুলনা থেকে: বেশিরভাগ ট্যুর অপারেটর খুলনা থেকে সুন্দরবন ট্যুর পরিচালনা করে। বড় লঞ্চ বা ছোট নৌকা ভাড়া নিয়ে কটকা, করমজল, হিরণ পয়েন্টসহ বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া যায়।
  • মোংলা থেকে: মোংলা বন্দর থেকে সহজেই করমজল, দুবলার চরসহ বিভিন্ন অংশে যাওয়া যায়।
  • শরণখোলা থেকে: পূর্ব সুন্দরবনের অংশে যেতে চাইলে শরণখোলা থেকে নৌকা বা ট্রলার নিতে পারেন।

সড়কপথে সংযোগ

সুন্দরবনের সরাসরি কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই, তবে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা বা বরগুনা পর্যন্ত বাস বা গাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে নৌপথে প্রবেশ করা যায়।

  • ঢাকা থেকে খুলনা বা মোংলা পর্যন্ত বাস/ট্রেনে যাওয়া যায়।
  • খুলনা থেকে মোংলা বা শরণখোলা যেতে লোকাল বাস বা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করা যায়।
  • মোংলা শরণখোলা থেকে নৌকায় সুন্দরবনে প্রবেশ করা যায়।

নিজস্ব নৌকা ভাড়া করে ভ্রমণ

যদি আপনি নির্দিষ্ট কোনো স্থানে যেতে চান, তবে খুলনা বা মোংলা থেকে নৌকা বা লঞ্চ ভাড়া করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে স্থানীয় নৌকা মালিকদের সাথে ভালোভাবে আলোচনা করে চুক্তি করা জরুরি।

সতর্কতা পরামর্শ

  • বন বিভাগের অনুমতি নিতে হবে (বিশেষ করে গভীর সুন্দরবন ভ্রমণের ক্ষেত্রে)
  • লাইফ জ্যাকেটসহ নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিতে হবে।
  • মৌসুম বুঝে পরিকল্পনা করা ভালো, সাধারণত শীতকালে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
  • জঙ্গল বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা মেনে চলতে হবে।

সুন্দবন মানেই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের হাতছানি। পদে পদে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সাথে হিম শীতল অনুভূতি।  এরকম একই সাথে বৈপরিত্যের মিশ্র অনুভূতি আপনি বাংলাদেশর আর কোথাও পাবেন না। সুন্দরবনে ভ্রমন আপনাকে চির স্মরনীয় এক অভিজ্ঞতা দিবে।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow