পাহাড় স্বর্গ তিন্দু ভ্রমণ
তিন্দু, বান্দরবানের থানচিতে অবস্থিত এক স্বর্গীয় প্রকৃতির লীলাভূমি। পাহাড়, নদী, ঝরনা ও মেঘের অপূর্ব সংমিশ্রণ এটি। সাঙ্গু নদীর স্বচ্ছ জলধারা, বিচিত্র পাথরের গঠন ও সাদা বালির সৌন্দর্য মুগ্ধ করে। এখানকার রংধনু দৃশ্য প্রকৃতির অনন্য উপহার, যা তিন্দুকে ভূস্বর্গ করে তুলেছে।

বাংলাদেশের পর্যটনকেন্দ্রের কথা উঠলেই সাধারণত কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সাজেক, সুন্দরবন, শ্রীমঙ্গলের নামই আগে আসে। তবে যারা ভ্রমণের সঙ্গে রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে চান, তাদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য হলো তিন্দু। তিন্দুকে বলা হয় বাংলাদেশের ভূস্বর্গ। এটি বান্দরবানের থানচি উপজেলায় অবস্থিত।
তিন্দু প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি, যেখানে পাহাড়, নদী, ঝরনা, আর মেঘের মেলবন্ধন এক স্বর্গীয় সৌন্দর্যের আবহ তৈরি করেছে। এটি পাহাড়ঘেরা এক নয়নাভিরাম উপত্যকা, যেখানে সাঙ্গু নদী বয়ে চলেছে আর তার দুই পাশে পাহাড়ি ঝিরিপথ থেকে অবিরাম স্বচ্ছ জলধারা প্রবাহিত হচ্ছে। তিন্দু পয়েন্ট থেকে উপরের দিকে উঠলেই সৌন্দর্যের নতুন নতুন রূপ চোখে পড়ে—চারপাশের বিচিত্র গঠনের পাথর, নীল-সবুজ পানির ঢেউ আর পাথরের ফাঁক গলে চলতে থাকা নৌকার দৃশ্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দেয়। আর পায়ের নিচের সাদা পাথুরে বালির সৌন্দর্য মুগ্ধ না করে পারে না। এখানে দেখা মেলে পানির ওপরে রংধনুর অপূর্ব দৃশ্য। প্রকৃতি তার সবটুকু সৌন্দর্য যেন ঢেলে দিয়েছে তিন্দুর বুকে।
তিন্দু ভ্রমণের উপযুক্ত সময়
তিন্দুতে বছরের যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়। প্রতিটি ঋতুতেই এটি ভিন্ন রূপে সেজে ওঠে।বর্ষাকালে খরস্রোতা সাঙ্গু নদীর গর্জন ও ঘন মেঘের মায়াবী আবহ ভ্রমণপ্রেমীদের মুগ্ধ করে। শীতে কুয়াশার চাদরে ঢাকা পাহাড় আর সূর্যের লুকোচুরি এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
ঢাকা থেকে তিন্দু যাত্রাপথ
ঢাকা থেকে তিন্দু যেতে চাইলে প্রথমে বান্দরবান পৌঁছাতে হবে। ঢাকা থেকে কলাবাগান, সায়েদাবাদ বা গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বান্দরবানের উদ্দেশ্যে নন-এসি ও এসি বাস ছেড়ে যায়।
এছাড়াও, চাইলে ঢাকা থেকে ট্রেন বা বিমানযোগে চট্টগ্রাম গিয়ে, সেখান থেকে বান্দরবান হয়ে থানচি ও তিন্দু যাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম থেকে তিন্দু যাত্রাপথ
চট্টগ্রামের বদ্দারহাট বা দামপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বান্দরবানের বাস পাওয়া যায়। এছাড়া চাইলে ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করেও যাওয়া সম্ভব।
বান্দরবান থেকে থানচি
বান্দরবান থেকে থানচির দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। এখানে যেতে বাস বা চাঁদের গাড়ি (জিপ) ব্যবহার করা যায়। রাস্তার অবস্থা ও যানবাহনের ওপর নির্ভর করে থানচি পৌঁছাতে সাড়ে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। তবে পথের মধ্যেই নীলগিরি, চিম্বুক ও মিলনছড়ির অপূর্ব দৃশ্যাবলী মন ভরিয়ে দেবে।
থানচি থেকে তিন্দু
থানচি পৌঁছানোর পর অবশ্যই একজন গাইড নিয়োগ করতে হবে, কারণ গাইড ছাড়া তিন্দুতে যাওয়া সম্ভব নয়। এরপর বিজিবি ক্যাম্প বা থানায় গিয়ে অনুমতি নিতে হবে। এ সময় পরিচয়পত্রসহ (জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্ট) প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করতে হয়। গাইড এসব কাজে সহায়তা করবে।
অনুমতি পাওয়ার পর থানচি থেকে তিন্দু পৌঁছাতে নৌকা ভাড়া নিতে হয়। ভ্রমণকারীর সংখ্যা, থাকার সময় ও প্রয়োজনীয় সুবিধার ওপর নির্ভর করে নৌকা ভাড়া নির্ধারিত হয়।
থাকার ব্যবস্থা ও খাবার
তিন্দুতে থাকার জন্য কোনো আবাসিক হোটেল নেই। স্থানীয় আদিবাসীদের বাঁশ ও কাঠের তৈরি ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের বাংলোতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
খাবারের জন্য এখানে কোনো রেস্তোরাঁ নেই। তবে স্থানীয়দের সহায়তায় রান্নার ব্যবস্থা করা যায়। চাইলে ভ্রমণকারীরা তাবু খাটিয়ে থাকতে পারেন এবং নিজেরা রান্না করে খাওয়ার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন, যা সত্যিই উপভোগ্য।
তিন্দু ভ্রমণের সতর্কতা
> নৌকাভ্রমণের জন্য লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করা আবশ্যক।
> সাঙ্গু নদীর স্রোত প্রবল, তাই সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
> মোবাইল নেটওয়ার্ক কার্যকর নয়, তাই গাইড ও গ্রুপের সবার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে।
> কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত বিজিবি ক্যাম্পে যোগাযোগ করতে হবে।
তিন্দু ভ্রমণ প্রকৃতির সান্নিধ্যে হারিয়ে যাওয়ার এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। যারা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য তিন্দু এক অনন্য স্বর্গরাজ্য। এখানকার পাহাড়, নদী, ঝরনা ও মেঘের অপূর্ব মিলনমেলা একবার দেখে এলে তা কখনোই ভুলে থাকা সম্ভব নয়!
What's Your Reaction?






